আমার চোখে ‘আন্টি বান্টেন’
দিনটা ছিল ২০২১এর ২রা জুলাই যখন আমরা সেই মর্মান্তিক খবরটি পাই। ক্যাম্পাসকেয়ারে দেওয়া নোটিশ টি পড়েই যেনো আমার পায়ের তলার মাটি খসে যাওয়ার উপক্রম হলো। জানতে পারলাম ম্যাম হালদা বান্টেন আর নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহমা শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি তাঁর অন্তিম নিশ্বাস পরিত্যাগ করেছেন।
নিবিড় তমসার মাঝে সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি বহু দশক ধরে প্রণয় ও উদ্দীপনার কিরণচ্ছটা স্ফুরিত করে যাচ্ছিলেন, আজ কোথায় যেনো হারিয়ে গেলেন তিনি। আমাদের সকলকে বিদায় জানিয়ে তিনি হেঁটে চলে গেলেন সহস্র আলোকবর্ষ দূরে, এক অচেনা হৈমক্ষেত্রে, এক অজানা স্বর্গরাজ্যে। ম্যাম বান্টেন, যাঁকে আমরা ভালোবেসে ‘আন্টি বান্টেন’ বলে ডাকতাম তাঁরই শরণে এক অঙ্কুরিত বীজের মতো কালক্রমে এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ হয়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠান এবার তাঁরই স্মরণে শোক বক্ষ মাঝে ধরে এগিয়ে চলবে।
স্কুলে আন্টি বান্টেনের অনেক গল্প শুনেছি। তাঁর জন্ম হয় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২১শে নভেম্বর জাপানের টোকিও শহরে, যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম পাঁচ বছর কাটে। তাঁর পিতার নাম রেভারেন্ড অ্যালেক্স মনরো, মাতার নাম গ্যান্ডলিন মনরো। তিনি কখনোই ভাবেন নি যে এইভাবে সমাজসেবার কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হবেন, কিন্তু পরমেশ্বর তাঁর জন্য আলাদা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। তাঁর হৃদয় পরিবর্তন হয় যখন তিনি একটি চার্চের সভায় জাজক মার্ক বান্টেনের বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হন এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের বিবাহ হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ও জাজক বান্টেন পরমেশ্বরের আহ্বানে কানাডা থেকে কলকাতায় আসেন এবং এখানকার দরিদ্র ও গৃহহীন শিশুদের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে পার্ক স্ট্রীটে দ্য অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ স্কুল গড়ে তোলেন। কলকাতার রাস্তা এবং বস্তিগুলিতে যারা অভাবনীয় প্রতিকুলতার মধ্যে বেঁচে ছিল তাদের জন্য দৈনিক পুষ্টিকর খাবারের ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে যখন যাজক বান্টেনের মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়, আন্টি খুবই ভেঙে পরেন। তখন মাদার টেরিজা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন “আমার যাজক মার্কের কথা খুব মনে পরবে। আমরা একসাথে বহু ভালো কাজ করে ছিলাম। তোমাকেও অবশ্যই এই ভালো কাজ গুলি চালিয়ে যেতে হবে।”
হালদা বান্টেন মানেই অন্তরের করুনার রত্নসম্ভার। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের হত দরিদ্র পথ শিশুদের এক সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রদান করার আরেকনাম হালদা বান্টেন, অসীম অনিশ্চয়তার মধ্যেও দৃঢ় সংকল্পে লড়ে যাওয়ার আরেক নাম হালদাবান্টেন, কালের অনন্ত পথে জনহিতার্থে কাজ করে মাইল ফলক তৈরি করার আরেক নাম হালদা বান্টেন।
আমার জীবনে কেবলমাত্র একটিবার আন্টি বান্টেনকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, ২০১৯ এ স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে। হৃদয়ে অনেকখানি অনুতাপ রয়ে গেল এই মহিয়সী নারীর সাথে যদি একটিবারের জন্য কথা বলার সুযোগ পেতাম তবে নিজেকে ধন্য বলে গণ্য করতাম।
অনলাইনে হওয়া তার স্মরণ সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে বক্তাবৃন্দ এবং শ্রোতাগন উভয় পক্ষই ক্রন্দন রোলে ভেঙে পড়েছিলেন। এই মহাপ্রয়াণের শোক সকলের বক্ষেই বিষাদের বজ্রাঘাত হেনেছে।
তার দৈহিক তিরোধাণ হলেও করুণাধন্য আশীর্বাদী হাতের ছোঁয়া আমরা আজও অনুভব করতে পারি। তিনি যেন না থেকেও আছেন। রাত্রির আকাশের ঝিলমিল করা অজস্র নক্ষত্রগুলি যেন বা আন্টি বানটেনেরই কত সহস্র চোখ, আমাদের দিকে যেন একই পরিচিত মাতৃস্নেহে, আপ্লুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।
—তপোব্রত রায়
অষ্টম শ্রেণি, বিভাগ- ঘ।